তুমি সৌন্দর্যের প্রতিভূ। পঁচিশ বছরের তোমাকে এক ছবিতে দেখছি এখন আমি- গভীর কালো চোখ, গাঢ় চাউনি, প্রাণবন্ত। জীবনকে আবিষ্কার করার নেশায় মেতে আছো। গ্রীষ্মের ঝাঁঝালো রোদজ্বলা দুপুরে উজ্জ্বল লাল সুইমিং স্যুট পরনে, আধভেজা দীর্ঘ সোনালী চুল, ম্যানহাটান বীচে বয়ফ্রেন্ড এডির হাত ধরে আছো। উচ্ছল হাসি দেখে মনে হচ্ছে জীবনের পরিপূর্ণতার সংজ্ঞা তোমাকে দেখে দেয়া যাবে। সেই ছবিটা সরিয়ে এবার আরেক তোমাকে দেখি, আরেকটি ছবিতে। কি অদ্ভুত বৈপরীত্য! চৌত্রিশ বছরের এই তুমি, হেমন্তের শুরুতে বিবর্ণ ম্যাপল পাতার মত, যেন ঝরে পড়ার অপেক্ষায়! শরীরের কাঠামোর ওপর চামড়ার প্রলেপ শুধু। চোয়ালের হাঁড় প্রকট হয়ে আছে, কোটরাগত চোখে আশার চিহ্নমাত্র নেই, মাথার চুল রুক্ষ, হাল্কা হয়ে এসেছে, ছোট করে কাটা। পরচুলা কিনা বুঝতে পারছি না। দুটো দেবশিশুকে দু'পাশে নিয়ে টাউনহোমের বাইরের সিঁড়িতে বসে আছো। ভাবলেশশহীন মুখে- কিন্তু চোখদুটো ভাল করে লক্ষ্য করলাম, হতাশা-আতঙ্ক-কান্না-বিষন্নতা, সব লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তোমার...
দ্বিতীয় এই ছবিটা ক্যামেরায় ধারণকরার মুহূর্তটাকে হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে আমি শিউড়ে উঠেছি! যে বা যারা ক্লিক করছিল- তারা জানত, তোমার জীবন আজ কি ভীষণ অনিশ্চিত! শুধুমাত্র কিছুটা সময় বেশি এই পৃথিবীকে আঁকড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা এখন তোমার! ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে তোমার ভুবন! যদি জীবনটাকে এ যাত্রায় কোনক্রমে টিকিয়ে রাখতে পারো, তাহলে তাকে ভীষণ যত্নআত্তিতে রাখবে- একমাত্র এই প্রতিজ্ঞা হয়ত তখন তোমার।
এই যে, এখন তোমার মাসটেকটমির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা নোট পড়ছি; তোমারই লিখা, "আমার সত্যিকারের অনুভূতি কি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমার নিশ্চয়ই খুশি হওয়া উচিৎ, কারণ আমি সারভাইভ করেছি! শুধু জানি, জীবনের কাছে আমি সত্যি অনেক কৃতজ্ঞ। সেই নীল আতঙ্ক, সেই ভয়াবহ দিনগুলো অতিক্রম করে আমি কৃতজ্ঞতার কাছে এসে নত হয়েছি। আমার বুক থেকে এক কঠিন ভার নেমে গেছে। একবছর আগের সেই ভয়াবহ দিনটার কথা মনে পড়ছে, যখন ডাক্তাররা কেমোথেরাপিতে একসাথে চারটা নিডল ব্যবহার করত, চারটা ভেইনে! আমি চিৎকার করে কাঁদতাম! যখন তারা চারনম্বর সিরিঞ্জটা আমার শরীরে ঢুকাত, মনে হত কিছু আগুনের ফুলকি ঢুকে যাচ্ছে আমার শিরায়। আমার পলকা ভেইন, আমার পলকা শরীর আর সহ্য করতে পারত না, হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগেই উগরে দিতাম সবকিছু। খালি পেট- তবু ধুঁকে ধুঁকে বয়ে চলা জীবনটাকে শুধু ভেতরে কোনভাবে রেখে যেন উগরে দিতাম সবকিছু! তার পরের চারদিন আধা-জাগ্রত হয়ে কাটাতাম, বমি করে সবকিছু বের করে দেয়ার সময় শুধু চেতনা ফিরে আসতো। কখনো ভাবতাম, ঘুমের ওষুধগুলো কয়েকটা একসাথে খেয়ে একবারেই কেন শেষ করে দেই না এই যন্ত্রণাগুলোকে? চারপাশে তাকাতাম উত্তরের আশায়। কিন্তু আমার সামনে খুব বেশি পথ কি খোলা আছে? বেছে নেয়ার মত? না। দুটো পথ শুধু, এই আগুনের হল্কা নিয়ে বেঁচে থাকো, অথবা মরে যাও! এডি আর বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র সাধ হতো।"
সঙ্গত কারণেই তোমার নামটা আমি উহ্য রাখছি মেয়ে। তবে ডকুমেন্টারির স্বার্থে একটা ছদ্মনাম তোমাকে দিতে হবে। খুব সুন্দর একটা নাম তোমাকে দিতে ইচ্ছে করছে। কম্পিউটারের স্ক্রীণ থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম, ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। "অরোরা"। তুমি অরোরা বোরিয়ালিসের মত- দীপ্তিময়ী, এবং সেইসাথে ক্ষণস্থায়ী। বলতে দ্বিধা নেই অরোরা, তোমার নোটটা পড়ে আমি কাঁদছি। তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবুও কাঁদছি। তোমার সাথে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়েছে গতকাল, জনসন কম্প্রিহেন্সিভ ক্যান্সার সেন্টারে। অভিমানে চলে গেছ, কিন্তু পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব রেখে গেছো কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে, কাগজের পাতায়, তোমার দুটো ছেলেমেয়ের মস্তিষ্কে, শরীরে, এডির মস্তিষ্কেও। ইউসিএলএতে ফিল্ম টেলিভিশান অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়াতে এমএফএ করছি আমি; ডকুমেন্টারি কোর্সের সাবজেক্টম্যাটার হিসেবে "ব্রেস্ট ক্যান্সার"বেছে নেয়ার কারণ হলো এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আমার বহু বহুদিনের। অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে সম্প্রতি ডঃ ব্রেইলের কেসগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেছিলে তুমি- আরও অনেকের সাথে। ডঃ ব্রেইল আমাকে তিনটা কেস স্টাডি করার অ্যাকসেস দিয়েছেন- এর থেকে আমার পছন্দমত একজনকে বেছে নেব আমি। সেই তিনজনের ভেতর একজন তুমি অরোরা- আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তোমাকে নিয়েই কাজ করব।
তোমার প্রোফাইলের আরো আগের দিকে যাচ্ছি আমি। ট্রায়ালের অংশ হিসেবে একটা জার্ণাল ছিল তোমার- তাতে নিজের অনুভূতির কথা প্রতিদিন লিখে যেতে তুমি। ধূসরবর্ণা সাত বাই পাঁচ ইঞ্চির সেই হার্ডকপি আমাকে আকর্ষণ করছে ভীষণ। তোমার লেখা নোটগুলো পড়তে চাইছি আগে- তোমার চোখে তোমাকে দেখতে চাই প্রথমে, সবচে' প্রথম নোটে লিখেছ, "আমাকে এইমাত্র জানানো হলো যে ইনভাসিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আমি আক্রান্ত। মাসটেকটমি করে লিম্ফনোডগুলো আগামী সপ্তাহেই সরিয়ে ফেলতে হবে শরীর থেকে। সত্যি বলতে কি, কথাটা শুনে আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম, মৃত্যুভয়ে! আমার দুটো ছোট ছেলেমেয়ে, এই অসুখ তো আমাকে অন্ততঃ মানায় না! শরীরের কোন অংশের বিচ্যুতি নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না! কাটাছেড়া যা ইচ্ছে করুক ওরা, কিন্তু আমাকে বাঁচতে হবে! যেভাবেই হোক, আমার বাচ্চাদের জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে হবে!!"
শরীরের বিচ্যুতি নিয়ে তোমার একান্ত ভাবনা বদলেছে আবার, ক'দিন পরেই। নারীত্বের অহংকার, মাতৃত্বের অহংকার নিয়ে তোমার শঙ্কার কথা লিখে গেছো পাতার পর পাতা, "আজ ডঃ যোশী অসুস্থতা নিয়ে বিস্তারিত কথা বললেন। বললেন আমার ডবল মাস্টেক্টমি প্রয়োজন হবে। প্রাথমিক ধাক্কা ইতোমধ্যে আমি সামলে উঠেছি। এই ক'দিন এ নিয়ে বিভিন্ন ওয়েব বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, অনেকের সাথে কথাও হয়েছে। সার্জারি সম্পর্কে ভয় তো আছেই, তার ওপর অঙ্গহানির পর আমাকে কেমন দেখাবে সেটা ভেবে আতঙ্কিত ছিলাম। ডক্টর জানালেন যে, অন্যান্য সার্জারির তুলনায় মাস্টেকটমি হয়ত খুব ভয়ঙ্কর না, হার্ট বা হিপ সার্জারি মাস্টেক্টমির থেকে জটিল। তবে অস্ত্রোপচারের পর শূন্যতা পূরণ বা পুনর্গঠনের ইচ্ছে থাকলে প্রয়োজনে আমার শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে পেশী এবং চর্বি সরিয়ে এনে অথবা প্রস্থেটিকস করা যাবে, তাতে আরো সার্জারির প্রয়োজন হবে।
এইসব শত বিভ্রান্তির মাঝখানে এডি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখছিল। এই শক্তিটুকু এই মুহুর্তে একান্ত দরকার আমার। কলেজে এডির প্রেমে পড়েছিলাম তার চোখ দেখে। সুন্দর নীল চোখ ওর। কিন্তু চোখের সৌন্দর্যই শেষ কথা ছিল না, সেই নীলে এক অদ্ভুত শান্তি আর শক্তির বন্ধন দেখেছিলাম। নীলের সেই আকর্ষণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা আমার পক্ষে রীতিমত দুঃসাধ্য ছিল। অনেকে আমার সাথে ডেট করতে চাইত, এডি তাদের তুলনায় অনেক চুপচাপ ছিল- কিন্তু সেই দৃষ্টি আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দেরি করায়নি। আজও সব উদ্বেগ, সব মানসিক চাপ -এডির চোখের দিকে তাকিয়ে ভোলার চেষ্টা করলাম। ও বলল, 'চিন্তা কোরো না তো! তুমি আমার স্ত্রী এবং আমি তোমায় ভালোবাসি। সার্জারিতে যে কোন পরিবর্তন আসুক না কেন, তাতে আমার, ড্যানি বা সোফির কিছু যাবে আসবে না। শুধুমাত্র তোমার শরীরের জন্য আমাদের বিয়ে হয়নি।' তাই যখন সার্জারি-পরবর্তী দাম্পত্যজীবনের কথা আলোচনায় এলো, তা নিয়ে সহজভাবে কথা বলা গেলো ডক্টরের সাথে। আমি জানি, শুধুমাত্র বিশেষ কোন অঙ্গ আমাকে একজন নারী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে না- আমি এর চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু! আমি একজন মানুষ! আমি একজন স্ত্রী, একজন মা, একজন বন্ধু, একজন বোন, এবং আরও অনেক অনেক কিছু! কাজের জায়গায় আমি একজন পেশাদার কর্মী। আমার পরিচয় শুধুমাত্র শরীরের একটি মাত্র অঙ্গতে সীমাবদ্ধ নয়।"
এই অজস্র প্রতিকূলতার মাঝেও তোমার অনুভূতি অবিমিশ্র নয়- তোমার আনন্দের কথাও এখানে লিখেছ অরোরা। "সোফিয়া আর ড্যানির অনেক শখ একটা অ্যাকুরিয়ামের। ওদেরকে বলেছিলাম, যেদিন ওরা নিজের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারবে, সেদিন কিনে দেব ফ্রেশওয়াটার ফিশের ছোট একটা অ্যাকুরিয়াম। তবে শর্ত হলো, মাছগুলোর যত্ন তাদেরকেই নিতে হবে। গতকাল হুট করেই মনে হলো, নিজের দায়িত্ব নিজে বুঝে নেয়ার মত সময় আদৌ কি মানুষের জীবনে আসে? এই আমিও ভেবেছি, আমি আমার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ সক্ষম এখন- কিন্তু না! বত্রিশ বছরের এই আমার পুরো শরীরটার দায়িত্ব অন্যদের হাতে, ডাক্তার-নার্স-সোশ্যাল ওয়ার্কার-কাউন্সেলর-স্পেশালিস্টদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আজ পেটশপ থেকে একটা অ্যাকুরিয়াম কিনে আনলাম- দুটো গোল্ডফিশ, আর একটি করে নীল ফাইটারফিশ, অ্যাঞ্জেল ফিশ এবং ময়ূরের মত পেখম মেলা গাপি। বাচ্চারা গোল্ডফিশদুটোর নাম দিয়েছে কেনার সাথে সাথে- ডোরা আর নিমো। ওদের হাসিমুখ দেখতে ভীষন ভালো লাগছে!"
আরেকটা নোট পড়ছি এখন, "একটা সময় ছিল যখন বিশ্বাস করতাম আমি হয়ত আর বাঁচব না, খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু হবে আমার। অনেক অনেকদিন লেগেছে আমার বিশ্বাস করতে, যে আমি বেঁচেও থাকতে পারি। আমি কোন "কেস" হয়ে জীবন কাটাতে চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম আমার ড্যানিয়েল আর সোফিয়ার পাশে থাকতে, প্রতিটা মুহুর্তে কিভাবে তারা বেড়ে উঠছে তা দু'চোখ ভরে উপভোগ করতে..."
অরোরা, তুমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলে যে তুমি বেঁচে উঠছ এ যাত্রায়। তারিখ দেখলাম এই নোটটার- ঠিক তার সাত মাসের ভেতর অনন্তের দিকে যাত্রা করেছ তুমি। নিঃশব্দ ঘাতক তোমার পিছু ছাড়েনি, সবার চোখের অন্তরালে সে লুকিয়ে ছিল কোথাও, তারপর শেকড় তোমার শরীরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দ্রুত বর্ধিত হয়েছে সর্বনাশা বৃক্ষের মত, তোমার যাবতীয় ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে! ছয় বছরের সোফি আর চার বছরের ড্যানি কিভাবে দিন কাটাচ্ছে আমি জানি না, জানা নেই তুমিই বা ওদেরকে ছাড়া কোথায় কেমন আছো। কোন পাপাত্মা তোমাকে খুন করেনি, বয়সজনিত স্বাভাবিক মৃত্যুও এ নয়। জেনেটিক অথবা পরিবেশের এক অজানা দুর্ঘটনায় এই মৃত্যু মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার। তুমি চেষ্টা করেছ আপ্রাণ অরোরা, শেষকালে নিয়তির হাতে হয়ত আত্মসমর্পণ করেছ; নিজেকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কখনো হয়ত ভেবেছ, পৃথিবীতে কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না। তুমি কি জানো মেয়ে, কারো কারো জন্য পৃথিবী সত্যি থেমে থাকে? থমকে যায়? গতিপথ বদলে যায়? কখনো কি জেনেছ, আজকের মত এক বিকেলে কমলা আলোর দ্যুতি ছড়ানো ঝলমলে পৃথিবীটাকে এক নিদারুণ ক্যানভাস বানিয়ে কারো কারো জন্য শুধু অমোচনীয় নীল রঙ ছড়িয়ে গেছো তুমি? কষ্ট হচ্ছে আমার, কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৪ সকাল ১০:৩২